সমান অধিকারের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে সরব বিশ্বব্যাপী কালো চামড়ার মানুষেরা। সম্প্রতি আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড হত্যা কাণ্ডের পরে শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সেই দাবি জোরালো হয়েছে আরও। অথচ ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, কালো চামড়াদের প্রতি সাদাদের এই বৈরিতার ইতিহাস চিরকালীন। তার থেকেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে কখনও কখনও নতুন ইতিহাস তৈরি করেছেন কোনো কোনো কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ। ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যে ভারতেও পা পড়েছিল সে রকমই একজন আফ্রিকানের, যিনি পরবর্তীতে পরিচিত হবেন মালিক অম্বর নামে।
মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের তীর-ধনুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকার যে কয়েকটি মিনিয়েচার ছবি পাওয়া যায়, তার একটিতে দেখা যায় জাহাঙ্গীর বাদশা দাঁড়িয়ে আছেন একটি অদ্ভুত স্থাপত্যের উপর। নিচে মাছ, তার ওপর গরু, তার উপর পৃথিবী এবং তার ওপর জাহাঙ্গীর বাদশা দাঁড়িয়ে সোনার ধনুক হাতে। সোনার তীর ছুড়ে মারছেন বর্শার ওপর গাঁথা এক কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের কেটে ফেলা মাথার হাঁ করা মুখের দিকে। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষটি দক্ষিণ ভারতের আফ্রিকান বংশোদ্ভূত গেরিলা সেনাবাহিনীর প্রধান চাপু ওরফে মালিক অম্বর— যিনি সপ্তদশ শতকে যথেষ্ট বেগ দিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর এবং পরবর্তীতে তাঁর পুত্র জাহাঙ্গীরকে।
যদিও আসল নাম তাঁর চাপু। ‘মালিক অম্বর’ একটি সম্মানসূচক উপাধি। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইথিওপিয়ায় জন্ম হয় চাপুর। সে দেশের নাম তখন হারার। আরও হাজার হাজার দেশীয়দের মতোই খুবই কম বয়সে ক্রীতদাস বানিয়ে চাপুকে নিয়ে যাওয়া হয় আরব দেশে। ইয়েমেনের মোচা বা মোকায় এসে ইসলাম ধর্মের সংস্পর্শে আসেন তিনি। ধর্ম পরিবর্তনের পর চাপুর সুগঠিত শরীর এবং প্রখর বুদ্ধিমত্তা নজর কাড়ে তাঁর তৎকালীন আরব মালিকের। উৎসাহিত হয়ে তিনি তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করে দেন, যা ছিল সেই সময় একদমই ব্যাতিক্রমী একটি ঘটনা।
মালিক অম্বর ভারতের ইতিহাসে পরিচিত একজন দুর্দান্ত আফ্রিকান সেনা প্রধান হিসেবে, যিনি খ্রিস্টিয় সপ্তদশ শতাব্দীতে দাক্ষিণাত্যকে রক্ষা করেছিলেন মুঘলদের হাত থেকে। কিন্তু শুধু এটুকু বললে কিছুই বলা হয় না তাঁর সম্পর্কে। বাগদাদে অম্বরের তৎকালীন মালিক কাজী হোসেন শুধুমাত্র তার পড়াশোনার দায়িত্বই নেননি, তাঁকে নতুন নামও দিয়েছিলেন, ‘অম্বর’। কিন্তু রোগভোগের কারণে কিছুদিন পরেই হোসেন মারা গেলে আবার অম্বরকে অন্যান্য ইথিওপিয়ানদের সঙ্গে বিক্রি করে দেওয়া হয় ভারতবর্ষে। অম্বরের নতুন মালিক হলেন, ভারতের আহমেদনগরের তৎকালীন শাসক চেঙ্গিস খান; ঘটনাচক্রে যিনি নিজেও ছিলেন প্রথম জীবনে একজন হাবশি ক্রীতদাস। বলা হয়, চেঙ্গিস খান ছিলেন সুলতান মুর্তাজা নিজাম শাহের পেশোয়া। চেঙ্গিস খানের অধীনে অম্বর সামরিক, কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক শিক্ষা এবং সংগঠনে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। কালক্রমে আহমেদনগরের সর্বাধিক ক্ষমতা সম্পন্ন হাবশি সৈনিক দলের প্রধান রূপে নিযুক্ত হন তিনি।
চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর অম্বর নিজস্ব সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলার দিকে মন দেন। আহমেদনগরের কিংবদন্তীতুল্য সুলতানা চাঁদ বিবির অসম সাহসিকতা এবং যুদ্ধে পারদর্শিতা গভীর ভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল অম্বরকে। বেশ কিছুদিন তাঁর অধীনে সেনাবাহিনী দেখভাল করার পর, ১৬০০ শতকের শুরুর দিকে প্রায় হাজার সৈনিকের একটি বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করে ফেলেন তিনি। ১৬১০ সাল নাগাদ দাক্ষিণাত্যের রিমোট কন্ট্রোল নিজের হাতে নিয়ে নেন মালিক অম্বর। রীতিমতো ‘কিংমেকার’ হয়ে ওঠেন তিনি। পরবর্তীতে ইংরেজ বণিক উইলিয়াম স্মিথের বর্ণনা দেখা যায়, মালিক অম্বরের নেতৃত্বে দশ হাজার হাবশি এবং চল্লিশ হাজার ভারতীয় মারাঠি সেনাবাহিনী ছিল। ছত্রপতি শিবাজীর পিতামহ মালোজিও ছিলেন মালিক অম্বরের সেনাবাহিনীর একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
কিন্তু নিজে রাজা হয়ে ওঠার বদলে অম্বর তার কূটনৈতিক বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন, রাজা তৈরি করা আরও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দু’জন রাজকুমারকে নিজামের সিংহাসনে বসার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি। বদলে চেয়ে নিয়েছিলেন মন্ত্রিপরিষদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক এবং অন্যান্য আরও বিশেষ ক্ষমতা। ভারতীয়দের কাছে ক্রমশই ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন অম্বর। তার জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ে যায় যে, ‘মালিক’ উপাধি দেয়া হয় তাঁকে। যদিও এই কারণেই মুঘলদের রোষানল থেকে রেহাই পাননি তিনি। আকবর এবং জাহাঙ্গীর বারংবার পদানত করতে চেয়েছেন তাঁকে। কিন্তু অম্বরের সৌজন্যেই আহমেদনগরের রাজধানী পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েও মুঘলরা তারপর আর অগ্রসর হতে পারেনি।
যদিও অম্বর বুঝতে পেরেছিলেন, শুধুমাত্র যুদ্ধ দিয়ে কখনোই কোনও অঞ্চলের উপর আধিপত্য স্থাপন করা যায় না। বরং অধিবাসীদের মন পেতে হলে দরকার সামগ্রিক উন্নয়ন। তাই নানারকম জনকল্যাণকর কাজের দিকেও প্রখর নজর ছিল অম্বরের। ১৬১৯-২০ সাল নাগাদ খিড়কি শহর গড়ার কাজে হাত দেন তিনি, যা পরবর্তীতে আওরেঙ্গজেব দখল করলে পরিচিত হয় আওরাঙ্গাবাদ নামে। দৃষ্টিনন্দন বাংলো, স্থানীয় বাজার এবং শহর জুড়ে অসংখ্য সুদৃশ্য প্রবেশদ্বার অম্বরের রুচিশীল স্থাপত্য জ্ঞানের পরিচায়ক। শহর জুড়ে স্থাপন করা হয় একাধিক সুদৃশ্য মসজিদ। শহরে সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রায় ২৪ মাইল দূরে খাল খনন করা হয় হিমালয়ের পাদদেশে। দীর্ঘ প্রায় ১৫ মাস নিরলস পরিশ্রমের পর তৈরি হয় নহর-ই-অম্বরই। প্রায় ৩০০ বছর ধরে কাজ করার পর পরবর্তীকালে এই ভূগর্ভস্থ খাল বা নগরীর সংস্কার কাজ করা হয় ১৯৩১ সালে। যদিও তখন ব্রিটিশ শাসকরা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না এই অপূর্ব পরিকল্পনা কার মস্তিষ্কপ্রসূত। মূল খালের নকশা অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে, প্রায় ৩০০ বছরেরও আগে একজন ক্রীতদাস রাজা হাত দিয়েছিলেন এই নকশা তৈরির কাজে।
বিশ্ব ইতিহাসে আফ্রিকানদের অবদান নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন লেখক ও ইতিহাসবিদ ডঃ ওমর হুসেন আলি। তাঁর ‘পাওয়ার অ্যান্ড স্লেভারি অ্যাক্রস দ্য ইন্ডিয়ান ওশেন’ বইতে মালিক অম্বর ও তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে বিশদে লিখেছেন তিনি। ডঃ আলিও অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে লিখেছেন যে, ১৬২৬ সালে মালিক অম্বরের মৃত্যুর পর বিভিন্ন মুঘল পণ্ডিতেরা যে ভাবে লেখালেখি করেছিলেন, তাতে শত্রু হলেও আকাশছোঁয়া সম্মানই বরাদ্দ হয়েছিল তাঁর জন্য! শিবাজীর কবিতাতেও যিনি বেঁচে আছেন ‘সূর্যের মতো সাহসী’ তকমা নিয়েই।